প্রতিবছরই
দুটি দিনকে মুসলমানরা ঈদ হিসেবে উদযাপন করে। অনেক দেশের অনেক সমাজেই ঈদ
এখন ধর্মীয় পর্বের উর্ধ্বে উঠে রূপ নিয়েছে সার্বজনীন এক সাংস্কৃতিক উৎসবে।
কিন্তু ঈদ উৎসবটির সত্যিকার তাৎপর্য যদি বুঝতে হয়, তাহলে সবচেয়ে
নির্ভরযোগ্য হলো নবীজি (স) এবং সাহাবাদের জীবনকে দেখা। তারা নিজেরা কীভাবে
ঈদ উদযাপন করেছেন। অন্যদেরকে করার তাগিদ দিয়েছেন। পাঠক আসুন, আমরা দেখি
নবীজি এবং সাহাবাদের জীবনে ঈদ।
ঈদের প্রচলন
মদীনায়
যাওয়ার পর নবীজি (স) দেখলেন, সেখানকার লোকজন দুটি দিনকে উদযাপন করে
খেলাধূলার মধ্য দিয়ে। নবীজি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দুদিনের কী তাৎপর্য
আছে? তারা বললো, আমরা জাহেলী যুগে এ দু দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি
বললেন : ‘আল্লাহ রাববুল আলামিন এ দু দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে
শ্রেষ্ঠ দু’টো দিন দিয়েছেন। তা হল ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ [সুনান আবূ দাউদ
: ১১৩৪]
শুধু খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে দু’টো দিন ছিল আল্লাহ
তায়ালা তা পরিবর্তন করে এমন দু’টো দিন দান করলেন যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া,
তাঁর জিকির, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সাথে পরিমিত আমোদ-ফুর্তি,
সাজ-সজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে। বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ গ্রন্থে ইবনে জারীর
রাদি আল্লাহু আনহুর বর্ণনা মতে, দ্বিতীয় হিজরিতে রাসূলুল্লাহ (স) প্রথম ঈদ
পালন করেছেন।
ঈদের নামাজ
নবীজী (স) দিনে
বের হয়ে দু’রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোন নামাজ
আদায় করেননি।’ [সহীহ বুখারি : ৯৮৯] শুধু ছেলেরা নয়, ঈদের জামাতে মেয়েদের
শামিল করানোর ব্যাপারেও নবীজি (স) তাগিদ দিয়েছেন।
উম্মে আতিয়া (রা)
বলেন, ‘আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (স) আদেশ করেছেন আমরা যেন মহিলাদেরকে ঈদুল
ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজের জন্যে বের করে দেই; পরিণত বয়স্কা, ঋতুবতী ও
গৃহবাসিনীসহ সকলকেই। ঋতুবতী নারীরা ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে সালাত আদায় থেকে
বিরত থাকবে তবে কল্যাণ ও মুসলিমদের দোয়া প্রত্যক্ষ করতে অংশ নিবে। তিনি আরো
বলেন, আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে কারো কারো
ওড়না নেই (যা পরিধান করে আমরা ঈদের সালাতে যেতে পারি)। রাসূলুল্লাহ (স)
বললেন, ‘সে তার অন্য বোন থেকে ওড়না নিয়ে পরিধান করবে।’ [সহীহ মুসলিম :
২০৯৩]
ঈদের দিন গোসল করা :
ঈদের দিন গোসল
করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছছন্নতা অর্জন করাকেও নবীজি গুরুত্ব দিতেন।
ইবনে উমার রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে,‘তিনি ঈদুল
ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।’ [সুনান বায়হাকী : ৫৯২০]
পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া :
আলী রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘সুন্নাত হলো ঈদগাহে পায়ে
হেঁটে যাওয়া।’ [সুনান আততিরমিযী : ৫৩৩] উভয় পথের লোকদেরকে সালাম দেয়া ও
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য যে পথে যাবে সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে
আসা। হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।’ [সহীহ বুখারী : ৯৮৬]
খাবার গ্রহণ :
ঈদুল
ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা এবং ঈদুল আজহার
দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানির গোশত খাওয়া
সুন্নাত। বুরাইদা রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার
দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না।’ [সুনান আততিরমীযি : ৫৪৫]
ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা :
ঈদে
পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা
এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন : (ক) হাফেয ইবনে হাজার রহমাতুল্লাহি
আলাইহি বলেছেন, সাহাবায়ে কিরামগণ ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন :
‘তাকাববালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ- আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভাল
কাজগুলো কবুল করুন। (খ) ‘ঈদ মুবারক’ ইনশাআল্লাহ। (গ) ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলে
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
ঈদের চাঁদ দেখার পর থেকে তাকবীর পাঠ করা :
তাকবীর
পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবীর হলো :
আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহু আকবার আল্লাহু
আকবার। ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
বাক্যটি উচ্চস্বরে পড়া। আবদুল্লাহ ইবনে
উমার রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর
পাঠ করতেন।’ [মুসতাদরাক : ১১০৬] যখন সালাত শেষ হয়ে যেত তখন আর তাকবীর পাঠ
করতেন না। বিশেষভাবে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে যখন বের হবে ও ঈদগাহে সালাতের
অপেক্ষায় যখন থাকবে তখন গুরুত্বসহকারে তাকবীর পাঠ করতে হবে।
নতুন বা পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা :
আব্দুল্লাহ
ইবনে আমর রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘আল্লাহ রাববুল আলামিন তাঁর বান্দার উপর তাঁর প্রদত্ত
নিয়ামাতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’ [সহীহ আলজামে : ১৮৮৭] ইবনুল কায়্যিম
রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন : ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
দু ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।’ [যাদুল
মায়াদ]
ঈদের খুতবা শ্রবণ করা :
আব্দুল্লাহ
বিন সায়েব রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘আমি নবী কারীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের
সালাত শেষ করলেন, বললেন : আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভালো লাগে সে যেন বসে আর
যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে।’ [সুনান আবূ দাউদ : ১১৫৭]
দোয়া ও ইস্তেগফার করা :
ঈদের
দিনে আল্লাহ তায়ালা অনেক বান্দাহকে মাপ করে দেন। মুয়ারিরক আলঈজলী
রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ঈদের এই দিনে আল্লাহ তায়ালা একদল লোককে এভাবে
মাপ করে দিবেন, যেমনি তাদের মা তাদের নিষ্পাপ জন্ম দিয়েছিল। নবী কারীম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘তারা যেন এই দিনে মুসলিমদের
জামায়াতে দোয়ায় অংশগ্রহণ করে।’ [লাতাইফুল মায়ারিফ]
মুসাফাহা ও মুআনাকা করা :
মুসাফাহা
ও মুআনাকা করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি হয়। আবু হুরায়রা রাদি
আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘একদা হাসান (রা) নবী কারীম (স) এর কাছে আসলেন,
তিনি তখন তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং কোলাকুলি করলেন।’ [শারহুস সুন্নাহ]
ফিতরাহ
দেয়া : রমজান মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের
খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের যে খাদ্য
সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে, শরীয়াতের পরিভাষায় তাকেই যাকাতুল ফিত্র বা
ফিতরাহ বলা হয়ে থাকে। হাদিসে বর্ণিত, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিলেন।’ [সহীহ
বুখারি : ১৫০৩]
এতিম ও অভাবীকে খাবার খাওয়ানো :
একবার
রসূল (স) ঈদের নামাজ পড়ানোর জন্যে বের হলেন। রাস্তার পাশে মাঠে কিছু
কিশোর খেলাধূলা করছিলো। কিন্তু তাদের একজন মাঠের এককোণে বসে কাঁদছিলো।
পরনে তার ছেঁড়া জরাজীর্ণ কাপড়। নবীজি (স) তাকে খেয়াল করলেন। কাছে গিয়ে
জিজ্ঞেস করলেন, সে কাদছে কেন। ছেলেটি বললো, তার মা-বাবা নেই। এমন কোনো
আত্মীয়ও নেই যার কাছে সে আশ্রয় নিতে পারে।
নবীজি (স) তার কথা শুনে
যারপরনাই কষ্ট পেলেন। বললেন, আজ থেকে আমিই তোমার বাবা। আয়েশা তোমার মা,
ফাতিমা তোমার বোন আর হাসান হোসাইন তোমার দু ভাই। তুমি কি সন্তুষ্ট?
ছেলেটি বললো, হে আল্লাহর রসুল (স) এত কিছু পেয়েও আমি কি সন্তুষ্ট না হয়ে
পারি। এরপর মহানবী (স) তাকে বাসায় নিয়ে গেলেন, সুন্দর জামা পরালেন এবং
তৃপ্তির সাথে খাওয়ালেন।
এরপর ছেলেটি হাসতে হাসতে আবার সেই মাঠে ফিরে
গেলো। অন্য ছেলেরা তার এ অবস্থা দেখে অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলো, কিছুক্ষণ আগে
না তুমি কাঁদছিলে? এর মধ্যে এমন কি হলো যে, তুমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে
গেলে? ছেলেটি বললো, আমি অনাহারে ছিলাম, পরিতৃপ্ত হয়েছি। পোশাকহীন ছিলাম,
পোশাক পেয়েছি। এতীম ছিলাম, আল্লাহর রাসুলকে পিতারূপে পেয়েছি তাঁর পরিবারের
সবাইকে আমার পরিবার হিসেবে পেয়েছি। এখন আমার চেয়ে সুখী আর কে আছে?
আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া :
ঈদের
সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার
বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেন, ‘যে আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বজায়
রাখে।’ [সহীহ বুখারি : ৬১৩৮]
প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেয়া :
ঈদের
সময় প্রতিবেশীর হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা
ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর
মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, ইয়াতীম, মিসকীন, প্রতিবেশী,
অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত
দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে, যারা দাম্ভিক,
অহঙ্কারী।’ [সূরা নিসা : ৩৬]
মনোমালিন্য দূর করা :
জীবন
চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারো কারো সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময়
পারস্পরিক মন-মলিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। হাদিসে
এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোন মুসলিমের
জন্য বৈধ নয় যে তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের
অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ঐ
ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়।’ [সহীহ মুসলিম : ৬৬৯৭]
আনন্দ প্রকাশ করা :
উম্মুল
মুমিনীন আয়েশা রাদি আল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন : ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দু’টি ছোট
মেয়ে গান গাইতেছিল, বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল
না। ইতোমধ্যে আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে
ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু
বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ [সহীহ বুখারি : ৯৫২]
এই লেখাটি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা। পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে কোয়ান্টাম সুন্দর একটি মিউজিক প্রকাশ করেছে যারা সংগ্রহ করতে চান তারা এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। ঈদ মোবারক।